কুমিল্লার দম্পতি সোহেল (৩৪) ও তানিয়ার (২৬) বিয়ে হয়েছে প্রায় ছয় বছর। বিয়ের পাঁচ বছরেও কোন সন্তান হয়নি তাদের যার সবটুকু দায়ভার এসে পড়ে তানিয়ার ওপর। দিনরাত শ্বশুরবাড়ির নানা গঞ্জনা পোহাতে হতো তাকে। সোহেলের মাও ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তারা প্রথমে গাইনি বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারলেন সোহেলের কিছু শারীরিক সমস্যার কথা। তখনই জানতে পারলেন ‘টেস্টটিউব বেবি’ সম্পর্কে। চিকিৎসক তাকে পাঠালেন স্কয়ার ফার্টিলিটি সেন্টারে, যেখানে সোহেলের মতো আরও অনেকে তাদের শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা পেয়ে সন্তান লাভ করেছেন।
তানিয়া জানালেন, মানুষ কিছুতেই বুঝতে চায় না যে সন্তান হওয়া না হওয়ার ব্যাপারটিতে কোন নারী এককভাবে দায়ী হতে পারেন না। নি:সন্তান হওয়ায় মানুষের কাছে অপয়া অপবাদও শুনতে হয়েছে আমাকে।
মিরপুরের মেহেদী (৩৮) ও বন্যার (৩৩) বিয়ে হয়েছে প্রায় আট বছর। মেহেদী একটি গার্মেন্টেসে চাকরি করেন। বন্যা টিউশনি করে কিছু আয় রোজগার করলেও তার সংসারের খরচেই চলে যায়। তবে নিজেদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়ার কারণে দিনগুলো সুখেই কাটছে তাদের। তারপরও আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের একটাই কথা এতগুলো বছর বিয়ে হয়েছে অথচ একটা সন্তান হলো না। চিকিৎসা করতে গিয়ে তারা জেনেছেন, তাদের শারীরিক কিছু সমস্যা আছে। তবে ‘টেস্টটিউব বেবি’র মাধ্যমে তারা তাদের এ আশা পূরণ করতে পারেন। তারা এটাও জেনেছেন, এ ব্যাপারটি খুবই ব্যয়বহুল যা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা চিকিৎসা স্খগিত রেখেছে।
ঢাকার বঙ্গবু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুলতানা জাহান জানালেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে হাজারও সামাজিক কুসংস্কার অজ্ঞতার রেড়াজালে সন্তানহীন দম্পত্তি কী যে অসহায় অবস্খায় জীবনযাপন করে তা বলে বোঝানো যাবে না। সামাজিক, পারিবারিক, দাম্পত্য পুরো জীবনটাই থাকে বিপর্যস্ত। আর যা হয়, পুরো দোষটাই পড়ে মেয়েটার ওপর। যদিও ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের অক্ষমতাই দায়ী।
একটি সন্তানের স্বপ্ন থাকে প্রত্যেক দম্পতিরই। তবু শারীরিক সীমাবদ্ধতা অনেক দম্পতিরই স্বপ্ন ছুঁতে দেয় না। সৃষ্টি করে জটিলতা, প্রতিবকতা। ইে প্রতিবকতা উত্তরণে বু হয়ে এলো বিজ্ঞান। আবিষ্কৃত হলো টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতি। আইভিএপ (ইন-ভাইট্রোফার্টিলাইজেশন) পদ্ধতির মাধ্যমে টেস্টটিউব বেবির জন্ম হয়। আশির দশকের বেশভাবে আবিষ্কৃত হওয়া এই প্রযুক্তির বাংলাদেশে আগমন ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবি হীরা, মণি ও মুক্তার জন্ম হয়।
হোপ ইনফার্টিলিটি সেন্টারের এমব্রায়েলজিস্ট এবং বঙ্গবু শেষ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের কনসালটেন্ট প্যাথলজিস্ট ডা. কামরুন নেছা বাণী বলেন, সবচেয়ে উন্নতর চিকিৎসা হলো আইভিএফ পদ্ধতি। এই চিকিৎসায় ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু শরীরের বাইরে গবেষণাগারে সংগৃহীত করে তাকে উর্বর করে ভ্রূণ তৈরি করে জরায়ুর মধ্যে স্খানান্তর করা হয়।
স্কয়ার হাসপাতালের ফার্টিলিটি সেন্টারের ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ডা. জাকিউর রহমান বলেন, সন্তানহীনতা একটি বড় ধরনের সমস্যা। সন্তানহীনতা বলতে সন্তানধারণ ক্ষমতাকে দুর্বল বা নষ্ট থাকাকে বোঝায়। একজন দম্পত্তির কাছে সন্তানহীনতার মতো কষ্টকর আর কিছু হতে পারে না। একজন দম্পতি সফল গর্ভধারণে সক্ষম হতে পারে কি না তা বহুভাবে নির্ধারণ করা যায়। আনুমানিকভাবে কারণগুলোর মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ নারী সম্পর্কিত, শতকরা ৪০ ভাগ পুরুষ সম্পর্কিত এবং শতকরা ২০ ভাগ উভয় সঙ্গীর সমস্যা রয়েছে এবং তাদের মূল্যায়ন প্রয়োজন।
গত ১০ বছরের গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতি ৮ জন দম্পতির মধ্যে একজন দম্পতি নি:সন্তান হয়ে থাকেন। জানালেন হোপ ইনফার্টিলিটি সেন্টারের ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ডা. মরিয়ম ফারুকী স্বাতী। এর কারণ হিসেবে অস্বাভাবিক শুক্রাণু, অনিয়মিত ডিম্বাণু, ইন্ডোমেট্রেসিস, অবর্ণনীয় বাত্ব ইত্যাদির কথা বললেন তিনি। এমআর (মিনস্ট্রুয়াল রেগুলেশন) এর ফলে টিউব অনেক সময় ব্লক হয়ে যেতে পারে বলেও তিনি জানালেন। তিনি আরও বলেন, ইনফার্টিলিটি সেন্টারে সব পদ্ধতি যদি ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে টেস্টটিউব বেবির কথা বলা হয়। প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ দম্পতিই টেস্টটিউব বেবি লাগে না। বাকি শতকরা ২০ ভাগ দম্পতির জন্য টেস্টটিউব বেবির প্রয়োজন হয়।
ইউনাইটেড নেশন্স পপুলেশন ফান্ড (ইউএনএফপিএ) ২০০৫ সালে একটি পর্যবেক্ষণে দেখিয়েছে, ভারতে ৪-১০ লাখের বেশি ব্যা দম্পতি আছেন। দুর্ভাগ্যবশত সবার মধ্যে সাধারণ বিশ্বাস যে তারা স্ত্রীর কারণে সন্তানহীন। কিন্তু স্বামীর ব্যাত্বের কারণেও এমনটি ঘটে। এর ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটে।
ডা. জাকিউর রহমান আরও বলেন, টেস্টটিউব বেবি চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা এতে ব্যয় হয়। তবে সবাইকে সেই পর্যায় পর্যন্ত যেতে হয় না। কারও কারও অল্প চিকিৎসাতেই সন্তান লাভ হয়। চিকিৎসার ব্যাপারটি বিভিন্ন জনে বিভিন্ন রকম হতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসার ব্যয়টি বেশি।
স্কয়ার হাসপাতালের ইনফার্টিরিটি সেন্টারে রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার ডা. সাহানা সুলতানা বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে একটা টিম এসে আইভিএফ করে যায়। এতে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লেগে যায়। এদেশে ফার্টিলিটি বিষয়ে কোন ট্রেনিং চালু হয়নি। এটা চালু হওয়া খুব প্রয়োজন। হাতেগোনা যে ক’জন ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ আছেন তারা বিদেশ থেকে এ বিষয়ে ট্রেনিং বা কোর্স করে এসেছেন। যদি আমাদের দেশেও এরকম ট্রেনিং চালু করা যায় তবে আমাদের আর বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হবে না এবং দেশের টাকা দেশেই থাকবে। মিডিয়াও এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক রাশিদা বেগম বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চার বছরে ১০০ টেস্টটিউব বেবির জন্ম হয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকে টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতির মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী প্রায় এক মিলিয়ন শিশুর জন্ম হয়েছে। এটি বেশ ব্যয়বহুল বলে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কম।
তিনি আরও বলেন, সন্তান না থাকায় বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাচ্ছে। গ্রামে প্রথম বছরের মধ্যে যদি একটা সন্তান না হয় তাহলে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে। সন্তান না হওয়ায় তারা বিয়ের একটা ইস্যু পেয়ে যায়।
স্কয়ার হাসপাতালের এমব্রায়োলজিস্ট ডা. সায়লা সিরাজ বলেন, আইভিএফের সফলতার হার বাংলাদেশে শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ। বিদেশে এই হার শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ। ভ্রূণ স্ত্রীর জরায়ুতে স্খাপন করার আগ পর্যন্ত কৃত্রিম পদ্ধতি। স্খাপন করার পর স্ত্রীর স্বাভাবিক গর্ভধারণের যেমন অনুভব করেন টেস্টটিউব বেবি নিলেও তেমনি অনুভব করেন। এতে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না।
নিপোর্টের বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে ২০০৭ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০ বছরের আগেই শতকরা ২৩ ভাগ নারী সন্তানধারণে সক্ষম থাকেন, ২০ বছরে সন্তানধারণে সক্ষম থাকেন শতকরা ৫৫ ভাগ নারী এবং ৩০ বছর বা তার পরে সন্তানধারণে সক্ষম থাকেন প্রায় এক পঞ্চমাংশ নারী। এমব্রায়োলজিস্ট ডা. সায়লা সিরাজ বলেন, বাংলাদেশে নারী-পুরুষ দু’জনের ক্ষেত্রেই বিয়ের আইনগত বয়স বেড়েছে। বিয়ের পরে সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে দেরিতে সন্তান নিচ্ছে। ফলে দম্পত্তিদের ইনফার্টাইল হওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখছে। দিন দিন এ অবস্খা বাড়ছে। ফলে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। ডা. মরিয়ম ফারুকী স্বাতী আরও বলেন, বাংলাদেশে সামাজিদ, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রথা ও নীতিতে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া সন্তানধারণ গ্রহণযোগ্য নয়। সন্তানাকাáক্ষী দম্পতি সব রকম টেস্ট করলেও কখনও তৃতীয় কারও মাধ্যমে সন্তান নেয়ার কথা ভাবতে পারে না। শুক্রাণু সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভ্রূণ তৈরির প্রক্রিয়ায় ঝুঁকির আশঙ্কা থেকে যায়। আমার স্বাীম-স্ত্রীর কাছ থেকে প্রায় একই সময়ে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিয়ে সংরক্ষণ করি। আর খুব অল্প রোগী নিয়ে থাকি। ফলে একজন দম্পতির জন্য আমাদের হাতে অনেক সময় থাকে। আমরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধান থাকি। ফলে ঝুঁকির সম্ভবনা কম থাকে।