ঘটনা-১
সাত-আট বছর আগের কথা। আমার চেম্বারে একজন প্রবাসী ভদ্রলোক ঢুকলেন তার স্ত্রীকে
নিয়ে। ভদ্রলোকের বয়স ৫৬ বছর। তার স্ত্রীর বয়স ১৭ বছর এবং ইনি তার পঞ্চম স্ত্রী।
রোগীর হিস্ট্রি এ রকম- তিনি প্রবাসে থাকেন। এক-দুই বছর পর পর ছয় থেকে আট মাসের
জন্য নিয়মিত দেশে আসেন। প্রথম স্ত্রী নিঃসন্তান থাকায় তিনি একের পর এক অপেক্ষাকৃত
কম বয়সের চারজন মেয়েকে বিয়ে করেছেন সন্তান লাভের আশায়। বর্তমানে স্ত্রীর সঙ্গে এক
বছর কাটানোর পরও সন্তান লাভে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি আমার কাছে এসেছেন। বিভিন্ন
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর স্ত্রীর কোনো সমস্যা আমার খুঁজে পাইনি। স্বামীর একটা
পরীক্ষায় সিমেন অ্যানালাইসিস করার পর দেখা গেল সেখানে কোনো শুক্রাণু নেই। ডাক্তারি
ভাষায় যাকে আমরা বলি অ্যাজোস্পার্মিয়া। অর্থাৎ সমস্যাটি ভদ্রলোকের নিজের। অথচ উনি
আগের চার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছেন তাদের সন্তান ধারণের অক্ষমতার কারণে!
ঘটনা-২
এক নিঃসন্তান দম্পতি আমার কাছে এসেছেন সন্তান লাভের আশায়। তারা আট বছর ধরে সন্তান
লাভের আশায় কয়েকজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং
ওষুধ খেয়েছেন। পূববর্তী পরীক্ষাগুলো দেখে বুঝতে পারলাম সমস্যাটি স্বামীর। স্বামীর
সিমেন অ্যানালাইসিসে দেখা যাচ্ছে যে, শুক্রাণুর সংখ্যা এবং গতিশীলতা স্বাভাবিকের
তুলনায় অনেক কম। ডাক্তারি পরিভাষায় আমরা যাকে বলি `oligoasthenospwrmia’। আমি
ভদ্রলোককে জানালাম, সমস্যাটি তার। এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আমাদের দেশে আছে। যদিও
চিকিৎসা পদ্ধতির একটা বড় অংশের জন্য তার স্ত্রীকে প্রয়োজন। ভদ্রলোক কোনোভাবেই মেনে
নিতে পারলেন না যে সমস্যাটি তার। তিনি বারবার তার স্ত্রীকে সন্তানহীনতার জন্য
দোষারোপ করলেন। এমনকি আমার সামনেই তিনি তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার হুমকি দিলেন!
ঘটনা-৩
এই দম্পতির পূর্বের ঘটনার মতো দীর্ঘদিন সন্তান লাভের চেষ্টা করেছেন এবং অনেক
ওষুধপথ্য খেয়েছেন। রোগীর পূর্ববর্তী প্রেসক্রিপশন এবং চিকিৎসা পরীক্ষা-নিরীক্ষায়
তার স্ত্রীকে ল্যাপারোস্কপি করার সিদ্ধান্ত দিই। এই পর্যায়ে স্ত্রী আলাদাভাবে আমার
সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি সম্মতি দিলে তিনি আমাকে জানান, বিয়ের পর তার স্বামী তার
সঙ্গে খুবই অল্প সংখ্যকবার থাকতে পেরেছেন। এমনকি তিনি জানালেন গত এক বছরে তাদের
মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। রোগীর এই হিস্ট্রি শোনার পর তার ল্যাপারোস্কপির
সিদ্ধান্তটি বাতিল করি। আমি স্বামীকে জানাই সমস্যাটি মূলত তার নিজের এবং মেয়েটির
চিকিৎসার পূর্বে তার নিজের চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
উপরোক্ত তিনটি ঘটনা থেকে আমাদের সমাজের একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। সব কটি
ক্ষেত্রে স্বামী সন্তানহীনতার কারণ হলেও তিনি তা মেনে নিতে পারছেন না। স্বামী নিজে
এবং পরিবারের অন্যান্য সবাই বারবার স্ত্রীকেই দোষারোপ করতে থাকেন সন্তান না হওয়ার
জন্য। অথচ নিঃসন্তান দম্পতিদের মধ্যে পুরুষেরা ৩০%-৪০% ক্ষেত্রে সন্তানহীনতার জন্য
দায়ী।
পুরুষদের সমস্যাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :
অ্যাজোস্পার্মিয়া, যখন বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা ও সক্রিয়তা কম থাকে, সেক্ষেত্রে আইইউআই বলে একটি চিকিৎসাপদ্ধতি করা যেতে পারে। প্রথমেই বলে নিই, সাধারণত কী কী কারণে আমরা আইইউআই করে থাকি এবং এর সুবিধাগুলো কী। আইইউআই মূলত পুরুষ সমস্যার কারণে করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে প্রথমে সিমেন সংগ্রহ করা হয় এবং এই সিমেনের মধ্যে যেসব স্পার্মেটোজোয়াগুলো নড়াচড়া করছে না এবং যেগুলোর গঠন-আকৃতি খারাপ, সেগুলোকে আইইউআই ল্যাবে মেশিনের সাহায্যে সেন্ট্রিফিউগেসান, সুইমআপ ইত্যাদি পদ্ধতির মাধ্যমে আলাদা করে ফেলা হয়। এরপর বাকি স্পার্মেটোজোয়াগুলোকে কালচার মিডিয়ায় রেখে এদের নড়াচড়া বৃদ্ধি করা হয়। এরপর একে আইইউআই ক্যাথারটারের সাহায্যে মহিলার জরায়ুর একটি নির্দিষ্ট অংশে প্রবেশ করানো হয়। সুতরাং আইইউআইর মাধ্যমে যাদের সিমেন শুক্রাণুর সংখ্যা কম বা শুক্রাণুর নড়াচড়া কম, এই দুই সমস্যাকে বাইপাস করা যায়। ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আবার লক্ষণীয় যে আইইউআই কখনো কখনো মহিলা বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে মহিলাটিকে বেশ কিছুদিন যাবৎ চিকিৎসা করা হচ্ছে, তার ল্যাপারস্কপি ভালো, তার স্বামীর সিমেন অ্যানালাইসিস রিপোর্টও ভালো। কিন্তু এরপরও কেন তাদের বাচ্চা হচ্ছে না, তা বোঝা যাচ্ছে না- এমন ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি বা দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসার একটা পর্যায়েও আইইউআই হতে পারে। যেমন, অ্যান্টিস্পার্ম অ্যান্টিবডি বা সার্ভিক্যাল মিইকাস বা অন্য কোনো কারণে গর্ভধারণ না হলে আইইউআই করা হতে পারে। আবার একটপিক প্রেগন্যান্সির কারণে কোনো মহিলার এক বা একাধিক টিউব যদি কেটে ফেলা হয়, সেক্ষেত্রেও গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য অনেক সময় আইইউআই করা হতে পারে। আমাদের দেশে আমরা অনেক সময় সেসব দম্পতির ক্ষেত্রে আইইউআই করে থাকি, যারা তাদের বিবাহিত জীবনে খুব কম সময়ই একসঙ্গে বসবাস করছেন; যেমন স্বামী হয়তো চাকরির কারণে বিদেশে থাকেন এবং সে কারণে স্বামী-স্ত্রী একত্রে থাকতে পারেন না। এদের ক্ষেত্রেও আইইউআই করে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ানো সম্ভব।
আইইউআই করার জন্য রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া বা অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয় না। এবং এটি রোগীর জন্য কষ্টদায়কও নয়। বিশ্বব্যাপী আইইউআই একটি আউটপেশেন্ট প্রসিডিউর। ‘রিট্রিভড সিমেন’ বা ‘পোস্টচ ওয়াশ সিমেন’ আইইউআই ট্রান্সফার রুমে’ এমনকি সাধারণ গাইনোকোলজিস্টের চেম্বারেও মহিলার জরায়ুতে ট্রান্সফার করা সম্ভব।
সাধারণত আইইউআই করে যেসব গর্ভধারণ হয়, তার বেশির ভাগই হয় প্রথম তিন
থেকে চারবারের মধ্যেই। সুতরাং তিন থেকে চারবার আইইউআই করার পরও যদি কোনো রোগী
গর্ভধারণ না করে থাকেন, তবে তার ক্ষেত্রে আইইউআই ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই
চলে। তাই আমার চেম্বারে আমি তিন থেকে চারবারের বেশি আইইউআই করা পছন্দ করি না। তবে
ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্রে বারবার চেষ্টা করা যেতে পারে।
তাহলে male infertility বা পুরুষ বন্ধ্যাত্বের কারণে
কখন টেস্টটিউব বেবি বা IVF/ICSI করা যেতে পারে।
অ্যাজোস্পার্মিয়া, যখন বীর্যে শুক্রাণু বা স্পার্মেটোজোয়া একেবারেই অনুপস্থিত
থাকে। গুরুতর অলিগোঅ্যাসথেনোস্পার্মিয়া, যেক্ষেত্রে শুক্রাণুর সংখ্যা ও সক্রিয়তা
এতই কম যে, আইইউআই করে লাভ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
এখন মনে হতে পারে যে সিমেন অ্যানালাইসিসে যদি শুক্রাণু একেবারেই না পাওয়া যায়, তাহলে আইভিএফের জন্য প্রয়োজনীয় শুক্রাণু কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়। এখানে লক্ষণীয় যে, অ্যাজোস্পার্মিয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে প্রথমত কোনো কারণে যদি শুক্রাণু তৈরি হওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে যেমন, ‘টেস্টিকিউলার ফেইলইউর বা ‘ম্যাচিউরেসান অ্যারেস্ট’-এর মতো কোনো সমস্যায়। দ্বিতীয়ত, শুক্রাণু তৈরি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এতে কোনো বাধা থাকার কারণে তা সিমেনে আসতে পারছে না। সুতরাং অ্যাজোস্পার্মিয়ার কারণ নির্ণয়ের জন্য আমরা রোগীর কিছু রক্ত পরীক্ষা করে থাকি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, রোগী যদি প্রথম কারণে অ্যাজোস্পার্মিক হন, তবে তার ক্ষেত্রে আইভিএফ করা সম্ভব নয়। কারণ, আইভিএফ করার জন্য স্বামীর কাছ থেকে অন্তত একটি হলেও শুক্রাণুর প্রয়োজন হয়। সৌভাগ্যক্রমে বেশির ভাগ রোগীরই অ্যাজোস্পার্মিয়ার কারণ দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ তৈরি হওয়া শুক্রাণু কোনো কারণে সিমেনে আসতে পারছে না। এমন ক্ষেত্রে, শুক্রাণু যেখানে তৈরি হয়, অর্থাৎ টেস্টিস বা এপিডিডিমিস থেকে ‘পারকিউটেনিয়াস এপিডিডিমাল স্পার্ম অ্যাসপাইরেসান’ বা ‘PESA’ এবং ‘টেস্টিকিউলার স্পার্ম অ্যাসপাইরেসান’ বা ‘TESA’ পদ্ধতির মাধ্যমে শুক্রাণুগুলোকে আমরা সংগ্রহ করি। আর রোগীর স্ত্রীর ডিম্বাণুগুলোকে ওষুধের মাধ্যমে আগেই বড় করা হয়। এরপর মহিলাকে অজ্ঞান করে আইভিএফ ল্যাবে এই ডিম্বাণুলোকে আলট্রাসনোগ্রাফিক গাইড্যান্সে ওভাম পিকআপ নিডেলের সাহায্যে আলাদাভাবে টেনে নেওয়া হয়। এরপর আইভিএফ ল্যাবে কালচার ডিশে সংগৃহীত শুক্রাণু ও ডিম্বাণুগুলোকে ফার্টিলাইজেসানের জন্য একত্রে রাখা হয়। ফলশ্রুতিতে কিছু কিছু ফার্টিলাইজেসান হয়। এরপর এই ফার্টিলাইজড ওভাম বা ডিম্বাণুগুলোকে মহিলার জরায়ুতে ট্রান্সফার করা হয়। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই পদ্ধতিই হচ্ছে ‘ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেসান’ বা আইভিএফ।
বিগত পনেরো বছরে ‘ইন্ট্রাসাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইনজেকসান’ বা ‘icsi’(ইক্সি) নামের একটি পদ্ধতি পুরুষ বন্ধ্যাত্বেও চিকিৎসায় বিপ্লব এনে দিয়েছে। যদি কোনো পুরুষের মারাত্মক অ্যাজোস্পার্মিয়া বা গুরুতর অলিগোঅ্যাসথেনোস্পার্মিয়া থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে শুক্রাণুর সংখ্যা এবং সক্রিয়তা অতিরিক্ত কম হওয়ার কারণে কালচার ডিশে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুকে একত্রে রাখলেও ফার্টিলাইজেসান হয় না। এসব ক্ষেত্রে ফার্টিলাইজ করার জন্য শুক্রাণু বা স্পার্মেটোজোয়াটিকে ইনজেকটিং পিপেটের সাহায্যে সংগ্রহ করে মাইক্রোম্যানিপুলেটরের নিচে ওসাইটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অন্যথায় এসব ক্ষেত্রে ফার্টিলাইজেসান হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভবপর হতো না। ‘ইক্সি’র মাধ্যমে তাই এমন দম্পতিকেও আমরা বাচ্চা এনে দিতে পারছি, যে ক্ষেত্রে স্বামীটি হয়তো অ্যাজোস্পার্মিক অথবা গুরুতর অলিগোস্পার্মিক। এখানে উল্লেখ্য, যেকোনো গুরুতর পুরুষ সমস্যার কারণে যে চিকিৎসাগুলো করতে হয়, সেটা iui, ivf অথবা icsi যেটাই হোক না কেন, তার পুরোটুকুই হয় তার স্ত্রীর ওপরে।