বন্ধ্যাত্ব আজকের প্রজন্মের অনেক দম্পতির কাছে এক বড় মাপের সমস্যা। এই সমস্যার প্রভাব পড়ে দাম্পত্য জীবনে। শুধু দাম্পত্য জীবনেই নয়, এর প্রভাব পড়ে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও। আজও অনেকে বন্ধ্যাত্ব নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে অনেকেই চান না। কিন্তু অন্য আর পাঁচটি সমস্যার মতো এটিও একটি শারীরিক সমস্যা। অথচ চিকিৎসার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান সম্ভব। এ সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে ‘রোদসী’ সম্পাদক সাবিনা ইয়াসমীন মুখোমুখি হয়েছিলেন আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের বন্ধ্যাত্ব ও টেস্টটিউব বেবি বিশেষজ্ঞ এবং ইনফার্টিলিটি ও রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মারুফ সিদ্দিকীর সঙ্গে।
রোদসী : কোন দম্পতিকে আমরা বন্ধ্যা বলতে পারি?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : সাধারণত একটা দম্পতি যখন কোনোরকম জন্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া অন্ততপক্ষে ১২ মাস চেষ্টা করার পরও সন্তান লাভে ব্যর্থ হয়, তখন আমরা তাদের নিঃসন্তান বলব। তবে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হওয়া সম্ভব।
রোদসী : বন্ধ্যাত্বের সম্ভাবনা বেড়ে যায় কখন?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : যতটুকু জানা গেছে, ৩৫-এর পরে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এটা বয়সের ওপর নির্ভর করে। তবে এখন দেখা গেছে, আগের চেয়ে কিন্তু বিয়ের বয়সটা কমে গেছে, ১০-১৫ বছর আগেও মেয়েদের বিয়ে দেরিতে হতো। কিন্তু এখন দেখা গেছে মেয়েরা ইয়াং বয়সে বিয়ে করে ফেলে, এ জন্য সুবিধা। আর একটা সুবিধা হচ্ছে, আগে অনেক মেয়েই অনেক দেরিতে আসত আমাদের কাছে। আর এখন অনেক মেয়ে আমরা দেখছি বিয়ে করার এক-দুই বছরের মধ্যেই আমাদের কাছে আসছে, এটা আমাদের জন্য সুবিধা। তবে বয়স একটা বড় সমস্যা, ৩৫ বয়সটাকে আমরা বলি রেড সিগন্যাল।
রোদসী : ছেলেদের ক্ষেত্রে?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : রেড সিগন্যালের ব্যাপারটা মূলত মেয়েদের ক্ষেত্রে, ছেলেদের ক্ষেত্রে নয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে তাদের শুক্রাণুর গতিসীমা ঠিক থাকলেই হয়। মূল হচ্ছে মেয়েদের বয়স। সেটা ৩৫-এর বেশি পার হলে আমরা বলি এখন অনেক সিরিয়াস হতে হবে।
রোদসী : প্রথম বাচ্চা কত বছর বয়সের মধ্যে নেওয়া নিরাপদ?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : প্রথম বাচ্চা ৩০-এর আগে হলেই ভালো হয়। সাধারণত সবারই লক্ষ্য থাকে দুটো যদি বাচ্চা নেওয়ার। যেহেতু দুটো সন্তানের মধ্যে ২-৩ বছর গ্যাপ থাকা ভালো, সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যদি ৩২-এর মধ্যে প্রথম বাচ্চা নিয়ে নিতে পারে, তাহলে কিন্তু ৩৫-এর মধ্যে দুটো বাচ্চা নিয়ে নিতে পারবে। এবং অনেক ধরনের সমস্যা কিন্তু ৩৫ এর পরে আসে। তাই আমরা উপদেশ দিই মেয়েদের ৩৫-এর মধ্যে তার পরিবার গুছিয়ে নেওয়া উচিত।
রোদসী : তাহলে কোন বয়সের মধ্যে বিয়ে করা এবং বাচ্চা নেওয়াটা উচিত কিংবা নিরাপদ মনে করেন?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : দেখা যাচ্ছে আজকাল অনেক মেয়েই ২৫-২৬ এর মধ্যে বিয়ে করে ফেলছে। সেটা ভালো। তবে বিয়ের বয়স যেটাই হোক প্রথম বাচ্চা ৩০-এর আগেই নেওয়া ভালো। আবার অনেক সময় কোনো মেয়ে ৩৩-৩৪ এ গিয়ে বিয়ে করছে। এমনও হতে পারো এটা হয়তো তার দ্বিতীয় বিয়ে, সময় না নিয়ে তারও তৎক্ষণাৎ বাচ্চা নিয়ে নেওয়া উচিত।
রোদসী : মেয়েদের কী কারণে বন্ধ্যাত্বের সমস্যা দেখা দেয়?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পুরো বন্ধ্যাত্বের ৩৫-৪০ ভাগ মেয়েরা দায়ী, তবে একইভাবে ৩৫-৪০ ভাগ পুরুষেরাও দায়ী। আর ১৫-২০ ভাগ ক্ষেত্রে উভয়ই দায়ী। আর বাকি ১৫-২০ ভাগের ব্যাপারে আমরাও জানি না আসলে কেন এমন হয়। তবে এখন পুরুষ বন্ধ্যাত্ব দিন দিন বাড়ছে। মেয়েদের মধ্যেও সমস্যা অনেক। এর মধ্যে বড় সমস্যা হচ্ছে মেয়েদের অনিয়মিত মাসিক। অনেক সময় ওভার ওয়েটও প্রবলেম করে। দেখা যায়, মেয়েটার মুখে বা হাত-পায়ে পুরুষের মতো লোম দেখা দিতে থাকে, অনেকের ব্রণ দেখা যায়, চুল পাতলা হতে থাকে অনেকের, অনেকের বিষণ্ণতা ভর করে।
রোদসী : তাহলে সমাধান?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : সুবিধা হচ্ছে এই সমস্যাগুলোর খুব ভালো সমাধান আছে। এতগুলো সমস্যার বাইরেও মূল সমস্যা হলো অনেক সময় দেখা যায়, মেয়েটার ডিম্বাণু ঠিকমতো তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু এখন সব ধরনের ওষুধই আছে মেয়েটার ডিম্বাণু তৈরি করার জন্য। আর ডিম্বাণু তৈরি করতে পারলে দেখা যায়, এদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যা ছয় মাসের মধ্যে প্রেগন্যান্ট হচ্ছে।
রোদসী : এ চিকিৎসাটা বেশি বয়সে অর্থাৎ চল্লিশের পরও সম্ভব কিনা?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : চল্লিশের পর হলেও সম্ভব। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, ডিম্বাণুর যে টোটাল সংখ্যাটাকে ওভার অ্যান্ড রিজার্ভ বলে অর্থাৎ একটি ওভারির মধ্যে কী পরিমাণ ডিম্বাণু থাকবে এটি কিন্তু জন্ম থেকেই নির্ধারণ হয়ে থাকে, এবং এটি আল্লাহ প্রদত্ত। এটাকে বাড়াতে বা কমাতে পারা যায় না। ফলে যত বেশি মেয়েটা মেনোপজের দিকে যাবে, ততই ডিম্বাণুর সংখ্যা কমতে থাকবে। এখন যখন একটি মেয়ের বয়স ৩০-৩৫ বছর তার যথেষ্ট ডিম্বাণু আছে, ওষুধ দিয়ে তার ডিম্বাণু তৈরি করা যাবে। কিন্তু যখন সে ৪০-৪২-এ চলে যাবে, তখন তার ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে যাবে, যত ওষুধই দেওয়া হোক না কেন ওটার বাইরে কিন্তু ডিম্বাণু তৈরি করা যাবে না। জেনারেলি তার সংখ্যা কমতে থাকবে।
রোদসী : এর মানে মেয়েদের সমস্যা হচ্ছে বেশি ওজন, অনিয়মিত পিরিয়ড এবং বিষণœতা, তাই কি?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : না, আর একটি সমস্যা হচ্ছে মেয়েদের ওভারিতে টিউমার থাকতে পারে। আর একটি কারণ হতে পারে টিউবে কোনো সমস্যা, ওভারি থেকে যে দুটি টিউবের মাধ্যমে ডিম্বাণুগুলো আসে সেই টিউবগুলো এক বা একাধিক কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে দু-একটি কারণ হচ্ছে মেয়েটির আগে কোনো অপারেশন হয়েছে এবং মূলত মেয়েটি যদি কোনো বাচ্চা নষ্ট করে থাকে। কোনো ডিএনসি বা কোনো এমআর করার মাধ্যমে, এ রকম অনেক রোগী কিন্তু পাওয়া যায়।
রোদসী : জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করলে কোনো সমস্যা হয়?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এটি একটি কমন প্রশ্ন। অনেক মেয়ে ভাবে আমি দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ করেছি তাই মনে হয় এমন হচ্ছে। এই ধারণা আসলে একেবারেই ভুল। জন্মনিয়ন্ত্রণের যে কোনো পদ্ধতি একেবারে নিরাপদ। কোন কোন পদ্ধতিতে দেখা যায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ছেড়ে দেওয়ার পরও তার প্রেগন্যান্ট হতে একটু দেরি হতে পারে। সেই সময়টা হয়তো ছয়-নয় মাস হতে পারে। তবে সবগুলোই মোটামুটি নিরাপদ। মনে রাখতে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণ কখনোই ভবিষ্যৎ বন্ধ্যাত্বের কারণ নয়।
রোদসী : পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের কারণ কী?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : পুরুষদের মূল সমস্যা তাদের বীর্য। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ছেলেদের যথেষ্ট পরিমাণ শুক্রাণু সংখ্যা কমে গেছে অথবা এর শুক্রাণুর গতিশীলতা কমে গেছে। সে কত দ্রুত সে যেতে পারছে ডিম্বাণুর কাছে। এটা কমে গেছে। এটিই মূল সমস্যা। সুবিধা হচ্ছে একটিমাত্র ছোট টেস্টের মাধ্যমে এটি বের করা যায়। অসুবিধা হচ্ছে মেয়েদের প্রতিটি সমস্যার জন্য আলাদা চিকিৎসা রয়েছে, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে ওষুধ ঠিকভাবে কাজ করে না। তাদের ক্ষেত্রে প্রায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে যেতে হয়। সমস্যা হচ্ছে এই পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল।
রোদসী : শুক্রাণু কমে যাওয়ার কারণ কী?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এটা এখন প্রায় সব দেশেই হচ্ছে। এ নিয়ে গত ৮-১০ বছর বিভিন্ন সেমিনার-সভা-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কারণ কেউ বলতে পারেনি। তবে একটি কমন কারণ হচ্ছে ধূমপান সমস্যা। যারা ধূমপান করে তাদের শুক্রাণু না কমলেও অনেক সময় গতিশীলতা কমে যায়। সুতরাং এটি একটি কারণ। যার স্বামী ধূমপান করে এবং শুক্রাণুতে সমস্যা আছে, তাদের প্রথমে আমরা ধূমপান বন্ধ করতে বলি। পরিবেশে যত বেশি দূষণ বাড়ছে, তত এ সমস্যা বেশি হচ্ছে। আরও একটি কারণ হলো মানুষের সাধারণ জীবনযাপনে স্ট্রেসের পরিমাণ বাড়ছে। স্ট্রেসের পরিমাণ যত বেশি বাড়ছে, তত বেশি শুক্রাণুর ওপর প্রভাব পড়ছে। ফলে এগুলোর গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং গতিশীলতা কমে যাচ্ছে। এসব মিলিয়ে পুরুষদের সমস্যা বাড়ছে। উপরন্তু ডায়াবেটিসের সংখ্যাও বাড়ছে।
রোদসী : অনেক সময় বলা হয় বংশগত কারণে এই সমস্যা হয়, তাই কি?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : বংশগত কারণটা আসলে আছে। কিন্তু আমরা যদি টোটাল কারণটাকে ধরি ১০০ ভাগ, তাহলে এই কারণটি মাত্র ১ ভাগ। ব্যাপারটা এত গৌণ যে, এটাকে আসলে কারণ হিসেবে না ধরলেও চলে।
রোদসী : সেক্সুুয়াল ব্যাপারে অনীহাও বন্ধ্যাত্বের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একটু বুঝিয়ে বলবেন?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এটি একটি বড় কারণ। অনেক নতুন কাপলকে দেখা যায় তারা উচ্চশিক্ষিত। উভয় তাদের প্রফেশন নিয়ে সিরিয়াস। আমার কাছে একটা দম্পতি আসে, তারা উভয়েই ব্যাংকার। তারা সকাল সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, আবার রাত ১০টায় বাসায় ফিরছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা অনেক ক্লান্ত থাকছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, একটি নবদম্পতি যেভাবে থাকছে বা থাকা উচিত তারা কিন্তু সেভাবে থাকছে না। এমন অনেক রোগী আছে তারা রাতে দুজন দুই বেডরুমে ঘুমায়। কারণ তারা এত বিজি যে, তাদের ঘুমটা অনেক জরুরি। আল্টিমেটলি এটা তাদের মানসিক শান্তি দিচ্ছে কিন্তু দিন দিন তারা বন্ধ্যাত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি মূলত দুজনই যখন বিজি থাকে, তখন হয়ে থাকে। আরেকটি সমস্যা আছে গ্রামে। দেখা যায় অনেকের স্বামী দেশের বাইরে থাকে। দুই বছর পরপর দেশে আসছে তিন মাসের জন্য। তারা এক-দেড় মাস চেষ্টা করে বাচ্চা না হলেই তারপর আমাদের কাছে আসছে। এসে হয়তো বলছে, স্বামীর যেতে এক মাস বাকি আছে। কিন্তু চিকিৎসার জন্য একটা যথেষ্ট সময় আমাদের দেওয়া হচ্ছে না।
রোদসী : কোন ধরনের রোগী বেশি আসছে? কী কী কমন সমস্যা পান?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : কমন সমস্যা হলো মেয়েরা প্রচুর ফাস্ট ফুড খাচ্ছে ফলে ওজন বেড়ে যাচ্ছে এবং অনিয়মিত মাসিক হচ্ছে। তবে একটু বলে রাখা ভালো, এখন কিন্তু চিকিৎসা করতে অনেক সুবিধা হচ্ছে। ১০-১২ বছর আগে পুরুষেরা ধরেই নিত তাদের কোনো সমস্যা নেই। এটা তার বউয়ের সমস্যা এবং এটা তাকেই সমাধান করতে হবে। বর্তমানে আমাদের কাছে আসলে প্রথমবার পুরুষ এবং মহিলা উভয়কেই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। দুজন একটা ইউনিট এবং তারাই রোগী। অনেক পুরুষের সমস্যা থাকলেও স্ত্রীর চিকিৎসা দিতে হবে, চিকিৎসাটা আবার আলাদা। অনেকের কাছে পুরুষ এবং স্ত্রী আলাদাভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে কিন্তু দুজনকে একই সঙ্গে না দেখলে সমাধান দেওয়া যবে না।
রোদসী : তাহলে মেয়েদের মোটা হয়ে যাওয়াটা অনেক বড় একটা কারণ। এটার সঙ্গে কি মাসিকের কোনো সম্পর্ক আছে?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এটার সঙ্গে মাসিকটা কিছুটা রিলেটেড। যত ওজন বাড়তে থাকবে তত মাসিকটা অনিয়মিত হতে থাকবে। এর মানে ওজন একটা বড় সমস্যা। কারণ, ওজনের সঙ্গে মাসিকের সম্পর্ক আর মাসিকের সঙ্গে বন্ধ্যাত্বের সম্পর্ক। আগে একটা সময় ছিল প্রেগন্যান্ট হলে বেশি খাওয়াদাওয়া করতে বলা হতো, যাতে তারা পুষ্টি পায়। আর এখন খাবার কমাতে বলা হয়, কারণ তারা খাবারের সঙ্গে এত বেশি সম্পৃক্ত যে, ডায়াবেটিসের ভয় থাকে!
রোদসী : অনেক সমস্যার কথা তো শুনলাম, এবার সমাধান সম্পর্কে জানতে চাই।
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : সৌভাগ্যবশত সমাধানগুলোর প্রায় শতভাগই আমাদের দেশে আছে। একটা সমস্যা হচ্ছে অনেক মেয়ের ডিম্বাণু তৈরি হয় না। ডিম্বাণু তৈরির সব ধরনের ওষুধ এখন আছে। মাসিকের নির্দিষ্ট দিন থেকে ডিম্বাণু তৈরির ওষুধগুলো দিয়ে দিই এবং মাসিকের ১২তম দিন আমরা মাসিকের রাস্তায় একটা টেস্ট করি। দেখা হয় পরিমিত ডিম্বাণু তৈরি হলো কিনা। যদি না হয়ে থাকে পরের মাসে তার ওষুধটা বাড়িয়ে দেওয়া হয় বা ইনজেকশন যোগ করা হয় আর এটা খুব সহজ সমাধান। বেশিরভাগ রোগীই এই ক্যাটাগরির, তাদের ডিম্বাণু তৈরি হচ্ছে না। তাই ডিম্বাণু তৈরি করতে পারলেই তারা বাচ্চা নিতে পারছে। অন্যান্য যে সমস্যা যেমন টিউমার বা অন্য কোনো সমস্যা থাকলে এখন আমাদের দেশে আল্লাহর রহমতে অপারেশনগুলো অনেক অ্যাডভান্স হয়ে গেছে। প্রচুর রোগীকে কেবল পেট কেটেই, পেটে ছিদ্র করে ওভারির টিউমারগুলো অপারেশন করতে পারছি এবং এটাতে রেজাল্ট খুব ভালো।
রোদসী : এতে খরচ কেমন?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : চিকিৎসার খরচ বলতে আপনি কোন সেটিংয়ে করবেন, কী রকমভাবে করবেন, তার সমস্যার ধরন কেমন- এসবের ওপর নির্ভর করে। এটা একটা কমন প্রশ্ন, অনেক রোগী জানতে চায় কেমন খরচ হবে। আসলে এর জবাব দেওয়াটা খুব মুশকিল। রোগীকে দেখার আগে বলা যায় না। কারণ তার আসল সমস্যা আমি জানি না, তবে অনেকের একটি ধারণা আছে এই চিকিৎসা শুরু করা মানে ব্যাপক একটা খরচ। আসলে তা নয়।
রোদসী : এটা কি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : হ্যাঁ, এটা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। যেমন ধরেন ১৫-২০ বছর আগে আমাদের দেশে হার্টের চিকিৎসা করতে দেশের বাইরে যেত, এখন কিন্তু যাচ্ছে না। কারণ, আমাদের দেশেই এটার উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে। বন্ধ্যাত্ব সেই দিকে যাচ্ছে, পার্থক্য হচ্ছে হার্টের চিকিৎসা একটা অপারেশন করে এলেই হচ্ছে। কিন্তু এটা তা নয়। এর সঙ্গে লেগে থাকতে হবে। সুবিধা হচ্ছে প্রচুর রোগী ৫-৬ মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এটি নির্ভর করে তার সমস্যার ধরনটি কেমন। অনেকের সামান্য সমস্যা থাকে, টোটাল ১৫-২০ হাজার টাকায় তার চিকিৎসা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকের দেখা যাচ্ছে টোটাল ৫-৬ লাখ টাকা লাগছে। টাকাটা নির্ভর করছে তার সমস্যার ওপর। পুরুষদের ক্ষেত্রে সমস্যা যেটা হচ্ছে, শুক্রাণুর সংখ্যা কম অথবা সংখ্যা ভালো আছে স্পিড কম। অথবা উভয়ই কম। পুরুষের ক্ষেত্রে ওষুধ কিন্তু খুব কাজ করে না, এ কারণে পুরুষ চিকিৎসা করা খুব ঝামেলা। এ ক্ষেত্রে প্রায় এদের বিভিন্ন পদ্ধতিতে যেতে হয়। যেমন আই ও আই পদ্ধতি এই পদ্ধতিতে ল্যাবে স্বামীর শুক্রাণু সংগ্রহ করে, যে শুক্রাণুগুলো নড়াচড়া করছে না সেগুলোকে আলাদা করে বাকিগুলোকে নড়াচড়া বাড়ানো হয়, সংখ্যা বাড়ানো হয়। এর পরে একটি পদ্ধতির মাধ্যমে মেয়েটির সরাসরি জরায়ুর ভেতরে দেওয়া হয়। আর একটি চিকিৎসা আছে যেটি ফাইনাল চিকিৎসা। যদি শুক্রাণুর সংখ্যা খুবই কম থাকে তাহলে আই ও আই করলে কাজ হবে না। সেক্ষেত্রে আপনাকে যেতে হবে সরাসরি টেস্টটিউব পদ্ধতি চিকিৎসায়। যেটাকে বলা হয় আইবিএফ এবং পুরুষ সমস্যার জন্য যেটা করা হয় সেটা হচ্ছে ইকসি। এটাতে দেখা যায় আল্টিমেটলি এটি জরায়ু এবং টিউব পার হয়ে ডিমটি যেখানে অপেক্ষা করছে, সেখানে যেতেই পারছে না। ফলে ল্যাবে এটাকে আলাদাভাবে সংগ্রহ করে তার স্ত্রী ডিম্বাণুও আলাদাভাবে সংগ্রহ করে ল্যাব এ ডিম্বাণুর মধ্যে শুক্রাণু ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এবং বাচ্চাটা ল্যাবেই তৈরি করা হয়। ল্যাবে তৈরি করার তিন থেকে পাঁচ দিন পরে আবার স্ত্রীর জরায়ুতে দেওয়া হয়।
রোদসী : কখন বলা যায় একটা দম্পতি বন্ধ্যাই, এরা আর বাচ্চা নিতে পারবে না।
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : আসলে এটা বলা মুশকিল, কারণ একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে, পুরো বিশ্বে ১১ ভাগ দম্পতি পুরো নিঃসন্তান। তারা অনেক রকম চিকিৎসা করার পরও ব্যর্থ হয়েছে। কারণটিও খুব পরিষ্কার। প্রায় ১৫ শতাংশ কারণ কিন্তু আমরা এখনো জানি না কেন এটা হচ্ছে। আর যে কারণটি আমরা জানি না সেটার কোনো চিকিৎসা নেই। তবে যারা ধৈর্যসহকারে চিকিৎসা নিচ্ছে তাদের একটা বিপুলসংখ্যক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে।
রোদসী : টেস্টটিউব বেবি কখন নিতে বলা হয়?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এটি একটি জটিল প্রশ্ন। ধরুন কিছু কিছু সমস্যায় সবগুলো স্তর পার হওয়ার পর যদি মেয়েটা প্রেগন্যান্ট না হয়, তখন আল্টিমেটলি বলা হয় টেস্টটিউব বেবি নিতে। কিন্তু কিছু কিছু সমস্যা আছে যেমন স্বামীর শুক্রাণু এতই কম যে অন্য কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না, স্ত্রীর ডিম্বাণুর সংখ্যা এতই কমে গেছে যে, কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না, স্ত্রীর দুটি টিউবই বন্ধ হয়ে গেছে যার ফলে নর্মাল চিকিৎসা করা সম্ভব নয়- এই রকম কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রথম চিকিৎসাই হতে পারে টেস্টটিউব।
রোদসী : এখন কেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এখন বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আগে এটা নিয়ে একধরনের কুসংস্কার ছিল আমাদের দেশে। এখন কিন্তু এ সমস্যাটা আর তেমন নেই। ১০-১২ বছর আগেও টেস্টটিউব বেবি নিতে আসলে স্বামী-স্ত্রী সন্দেহ পোষণ করত। এটা কার বাচ্চা হবে, আমাদেরটা দেওয়া হবে তো? সন্দেহটা যে একেবারে অমূলক তাও কিন্তু নয়। কারণ, কিছু কিছু দেশে ডোনার ব্যবহার করা হয়। যদিও বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ এবং আমাদের দেশে আমরা ডোনার ব্যবহার করি না। কাজেই আমাদের দেশে এই সমস্যা নেই।
রোদসী : হঠাৎ করেই রোগী বৃদ্ধির কারণ কী?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : আমাদের রোগী বৃদ্ধির কারণ কিন্তু অনেক। প্রথমটা হচ্ছে জনসচেতনতা অনেক বেড়ে গেছে। আগে কাপলরা আমাদের কাছে আসতে একটু আনইজি ফিল করত। এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের রোগীর কোনো অভাব নেই। এবং রোগীরাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে আমাদের কাছে আসতে। তারা জানতে চাচ্ছে তাদের সমস্যার সমাধান সম্পর্কে, চিকিৎসায় লেগে থাকছে এবং অনেকে প্রেগন্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখে বাকিরাও কিন্তু এগিয়ে আসছে। আর একটা বড় ব্যাপার অনেক রোগী তাদের সমস্যাগুলো নিঃসংকোচে অন্যদের সঙ্গে বলছে। এটি আমাদের সমস্যা ছিল, আমরা সমাধান করেছি এবং আমরা সন্তান লাভ করেছি। আগে চিকিৎসা করে বাচ্চা হলেও বলত না। অনেকে হয়তো টেস্টটিউব করে বাচ্চা নিয়ে গেছে কিন্তু বলতে লজ্জা পাচ্ছে। এই সমস্যা থেকে আমরা বের হয়ে আসছি। বিশেষ করে শহর অঞ্চলের রোগীদের এই সমস্যা আমরা আর ফেজ করিই না।
রোদসী : টেস্টটিউব বেবির ক্ষেত্রে খরচটা কেমন?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এক্ষেত্রে খরচ নির্ভর করে কোথায় এটা করা হচ্ছে, মেয়েটার বয়স কেমন তার ওপরও। ফলে এটা বলা সম্ভব নয়। তবে একটা রেঞ্জ বলা যেতে পারে। সাধারণত আড়াই থেকে চার লাখ লাগতে পারে। সর্বনিম্ন দুই লাখ বিশ-ত্রিশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ চার লাখ হতে পারে।
রোদসী : টেস্টটিউব পদ্ধতি কি শতভাগ সফল হয়?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এতেও অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ প্রেগন্যান্ট হচ্ছে। আমরা রোগীদের আগেই বলে নিই, এত টাকা খরচ করার পরও কিন্তু ফল নাও আসতে পারে।
রোদসী : স্মাম ডোনেট করার ব্যাপরটা কেমন?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : আমাদের দেশে সাধারণত আমরা ডোনার ইউজ করি না। আসলে সে ক্ষেত্রে অনেক ধর্মীয় বাধানিষেধ রয়েছে।
রোদসী : টেস্টটিউব বেবি নেওয়ার কোনো এজ লিমিটেশন আছে?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : অনেক মেয়ে আমার কাছে আসে তখন যখন তার টেস্টটিউব বেবি করা উচিত ছিল হয়তো তারও ১০ বছর আগে। দেখা যাচ্ছে, তারা হয়তো ৩৮-৩৯ বছর বয়সে আসছে। এটারও কি একটা বয়স সীমাবদ্ধতা থাকে। মেয়েটি যত কম বয়সী থাকবে তার প্রেগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা তত ভালো থাকে। টেস্টটিউব যদি করতে হয় আমরা সাজেস্ট করি ৩২-৩৫-এর মধ্যে করে ফেলতে পারলেই ভালো। তাতে সাকসেস রেট বেশি হয়।
রোদসী : বাংলাদেশে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে কমন কারণ কোনটি মনে হচ্ছে?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : মেয়েদের কমন কারণগুলো হলো ওজন বেড়ে যাওয়া, মাসিক অনিয়মিত হয়ে যাওয়া এবং ডিম্বাণু তৈরি না হওয়া। ছেলেদের কমন কারণগুলো হচ্ছে শুক্রাণুর সংখ্যা এবং নড়াচড়া বা গতিশীলতা কম থাকা ও উভয় কম থাকা।
রোদসী : মানসিক স্ট্রেস থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা সম্ভব?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : আসলে এ থেকে বের হয়ে আসা মুশকিল। খেয়াল করে দেখেন, এর জন্য মূলত আমাদের সামাজিক পরিবেশ দায়ী। আমাদের দেশে যখন কোনো মেয়ের সন্তান হয় না, সে মোটামুটি সামাজিকভাবে একটু একঘরে হয়ে যাচ্ছে। তার নিজের জন্য ব্যাপারটি ইমবারেজিং। সে আস্তে আস্তে দেখা যায় সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে সে সামাজিকভাবে নিজেকে একঘরে করে ফেলছে। কারণ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে তাকে শুনতে হয় কেন বাচ্চা হচ্ছে না? এর কাছে যাও ওর কাছে যাও। এই চিকিৎসা করো, সেই ওষুধ খাও ইত্যাদি। এই সমস্যাটি কিন্তু অন্য দেশে তেমন নেই। কিন্তু আমাদের দেশে সবাই এ কাজটা করে। যদিও এটা খুব ব্যক্তিগত প্রশ্ন। যদিও জিজ্ঞেস করাটা উচিত নয় তবুু অনেকে জিজ্ঞেস করে। এটি মেয়েটির ওপর সমস্যা তৈরি করে। তার ওপর মানসিক চাপ পড়ে। এবং এ কারণে তার বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা আরও কমে যায়।
রোদসী : পাঠকদের জন্য কোনো পরামর্শ?
ডা. মারুফ সিদ্দিকী : এটি এমন একটি সমস্যা, যার প্রায় শতভাগ চিকিৎসা বাংলাদেশে করা সম্ভব। এটি একটি বড় সুবিধা। সাধারণত রোগীদের মনে একটি ভয় আছে, এ চিকিৎসাটি খুবই ব্যয়বহুল। এটি ভুল। প্রথম চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল নয়, তবে অনেক সময় এমন কিছু সমস্যা পাওয়া যায়, যেটা একটু ব্যয়বহুল হয়। আজকাল অনেক রোগী আমাদের কাছে আসেন চিকিৎসা নেন এবং এদের অনেকেই খুব দ্রুত প্রেগন্যান্ট হচ্ছে। কিন্তু খেয়াল রাখবেন এটা জ্বরের মতো কোনো অসুখ না যে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিলাম আর ভালো হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, অনেক সময় আমরা একদম সঠিক চিকিৎসা করলেও সব রোগী প্রেগন্যান্ট হবে না। ফলে তাদের আমি বলব ধৈর্য ধরে সঠিক চিকিৎসক নির্বাচন করতে হবে এবং তার কাছে ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করতে হবে, কখন তার ভাগ্য সহায় হয়। হতাশ হলে চলবে না, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা।